ছোটবেলা থেকে গজুকে খুব পছন্দ করে তিথি। গজু দেখতে খুব সুন্দর। একেবারে নায়ক নায়ক চেহারা। ওর লম্বা লম্বা দুটো হাত আছে, সোজা সোজা পা, পায়ে গামবুটের মতো জুতো। মাথাজোড়া কোঁকড়া কালো চুল যা উল উল মনে হয়। আর চোখ দুটো এমন টানা টানা যে মনে হয় কোন আর্টিস্ট দামী কলম দিয়ে একেঁছে তার চোখ দুটো। তবে বাইরে থেকে দেখলে বোঝা না গেলেও কাপড়ের নিচেই রয়েছে গজুর খড়ের তৈরী শরীর। হাওয়াই চপ্পলের রবার কেটে তার ওপর উল জড়িয়ে বানানো হয়েছে হাতটা। মাথার চুলগুলোও এমন উলের তৈরী। তিথির বাবা সেই ছোট বেলায় তিথির জন্য বানিয়ে দিয়েছিলেন এই পুতুলটা। তিথি তখন এক বছর বয়সী। বাবাই তার সব। তিথির জন্মের সময় মা যখন না ফেরার দেশে চলে গেলেন তখন থেকে বাবাই তার বাবা, বাবাই তার মা। স-অ-ব। বাবার হাতে টাকা ছিলোনা তখন। চাকরি নেই। তিথি রাতদিন কাঁদতো। বাবা তাকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করতো। তিথি কি বোঝে? তার বয়স মাত্র এক বছর। তখন বাবা তাকে এই গজু বানিয়ে দিয়েছিলো। বাবাই দিয়েছিলো এই অদ্ভুত নাম। বাবাই এই পুতুলটা দিয়ে তার সাথে খেলতো। পুতুলটা উঁচু করে ধরে গলার চিকন স্বরে কথা বলতো, পুতুলটাকে হাঁটাতো, তিথির সাথে খেলাতো। তিথি খুব মজা পেত তাতে। দশ বছর পর্যন্ত তিথির সাথে বাবা এটা দিয়ে খেলতো। তারপর একদিন হঠাৎ বাবাও চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তিথি একেবারে একা হয়ে গেল। তারপর তিথি আশ্রয় পেল মামার বাড়িতে। সেখান থেকেই পড়া শোনা করতে শুরু করলো। বাবার কাছে থাকার সময় সে ফোরে পড়তো। মামার কাছে থাকার সময় সে ফাইভে ভর্তি হলো। মামা কি কখনও বাবা হতে পারে? পারেনা। তিথির মামাও পারেনি বাবা হতে। মামার পরিবারে থাকার সময় তিথিকে দিয়ে ওর মামি বাড়ির কাজ করাতেন। যদিও ওর পড়াশোনা বন্ধ হলোনা তবে ওর এই বাড়িতে থাকাটা অনেকটা নির্ভর করতো ও কি কি কাজ করবে তার ওপর। তিথি কখনও না বলেনি। ও সাধারন আর দশটা মেয়ের চেয়ে একটু বেশীই বুঝতো। যে ছোটবেলায় মা বাবাকে হারায় সে অন্য মেয়েদের মতো হতে পারেনা। সে বাবা মার সাথে আত্মীয়দের পার্থক্য বোঝে। তাই মামি তাকে যে কাজটা করতে বলতো সে বিনা দ্বিধায় কাজটা করে দিতো।
বাবা মারা যাবার পর মামার বাড়িতে চলে আসার সময় তার মামা তাদের বাড়িতে যেসব জিনিষপত্র ছিলো সব বিক্রি করে দিয়েছে। তিথি বাধা দিতে বলেছে, এসব দিয়ে কি করবি? এগুলো লাগবেনা। আমাদের বাড়িতে তো সব আছে। এগুলো ঝামেলা, বিদায় করে দেই। মামা ওদের বাড়ির সব আসবাবাপত্র বিক্রি করে দিয়ে বাড়িটা ছেড়ে দিয়েছেন। তবে সব বিক্রি করে দিলেও তিথি গজুকে কাছছাড়া করেনি। গজু এই বয়সেও তার নিত্যসঙ্গী। তিথির বয়স এখন তেইশ। ইন্টার পাশ করে ডিগ্রিও শেষ করে ফেললো বলে। আর ক’দিন পরই ফাইনাল পরীক্ষা। এই বয়সেও গজুকে বিছানায় নিয়ে ঘুমায় ও। গজুর সাথে কথা বলে। গজুর সাথে সুখ দুঃখের আলাপ করে। কোথাও বেড়াতে গেলে গজুকে ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে নিয়ে যায়। অনেক কিছু খেতে ই”েছ করে তিথির। যেমন বাবা বেঁচে থাকতে তিথি নুডলস খেতে খুব পছন্দ করতো, এখনও করে। বাবার কাছে চাইলেই, টাকা না থাকলেও, বাবা দোকান থেকে বাকিতে নুডলস কিনে এনে রেঁধে দিতো ওকে। যখন যেটা চাইতো, বাবা ওকে তাই দিতো। কিš‘ মামার কাছে আসার পর কোনদিন মুখ ফুটে বলেনি যে, মামা এটা খাবো বা মামা এটা আমি খেতে পছন্দ করি। মামি নুডলস রান্না করলেও ওকে দিতোনা। নিজের ছেলে মেয়েদের দিতো, তিথি দেখলেও কোনদিন খাবার জন্য বলেনি ওকে। তিথিও না দেখার ভান করে গেছে। ওর মন খারাপ হয়নি কোনদিন। ও মনকে বারবার বুঝিয়েছে যে ওদের মা আছে, কিš‘ আমার মা নেই। যার মা নেই তার কিছু নেই, তার কোন শখ নেই, তার কোন ই”ছা নেই, তার কোন অনুভুতি নেই। আর তার তো শুধু মা নয়, তার বাবাও নেই।
কিš‘ মন খারাপ হলো তখন যখন সার্জিল ওকে ছেড়ে গেল। মা ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো ছোটবেলায়। মাকে না দেখায় ওর কষ্ট ছিলোনা। মায়ের অনুভুতিটা কেমন বোঝা হয়নি। বাবা যখন ছেড়ে গেল তখন মামা এসে দাঁড়িয়েছিলো পাশে। ওকে সান্তনা দিয়ে বলেছে, চিন্তা করিসনা, সবাইকে একদিন মরতে হয়। আবার ওদের সাথে তোর দেখা হবে। মৃত্যুর পর। ততক্ষন খালি ধৈর্য্য ধর। বাবার শোক কাটিয়ে উঠেছিলো তিথি। কিš‘ সার্জিলের শোক কাটিয়ে উঠতে পারছেনা ও। এই নতুন ভাড়া বাড়িতে আসার পর থেকেই সার্জিলের সাথে ওর পরিচয়। সার্জিলরা ওদের বাড়ির উল্টোদিকে থাকতো। ওদের বাড়িটা তিনতলার ফ্লাটে আর সার্জিলদের বাড়িটা চারতলায়। একেবারে মুখোমুখি। ও বারান্দায় গেলেই সার্জিল ইশারায় কথা বলতো ওর সাথে। দুষ্টুমি করতো। এভাবেই একদিন ছেলেটাকে ভালো লেগে গেল ওর। আর এতোটাই ভালো লাগলো যে নিজের জীবনের চেয়ে ভালোবেসে ফেললো সার্জিলকে। এভাবে দুটো বছর চলে গেল। তিথি সার্জিলের কথায় নিশ্চিত হয়ে গেল যে সার্জিল ওকে বিয়ে করতে চায়। সার্জিলরা ধনী। তিথির চাচাদেরও বাইরের ঠমক দেখে মনে হয় তারাও বেশ টাকা পয়সার মালিক। সার্জিলের বাবা মাও মেনে নেয় বিয়েটাকে। কিš‘ শেষ রক্ষা হয়না। সার্জিলের পরিবার কিভাবে যেন জেনে ফেলে তিথির মা বাবা কেউ নেই। সে চাচার পরিবারে থেকে বড় হয়েছে। এ কথা জানার পরই ওরা পিছিয়ে যায়। এমনকি সার্জিলও ওর এতোদিনের ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যান করে। খুব দ্রুতই ওরা সার্জিলের বিয়ে ঠিক করে ফেলে। তিথি যখন জানতে পারে সার্জিলের বিয়ে ঠিক হয়েছে তখন পুরো পৃথিবী ওর অন্ধকার হয়ে যায়। আকাশের কালো মেঘের মতো ওর পুরো মুখ এক অজানা ছায়ায় ঢেকে যায়। ওর মানসিক শক্তি হয়ে পড়ে স্তিমিত। নিজের বিছানায় শুয়ে মাথার বালিশটায় মুখ গুঁজে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে তিথি। কিছুতেই ওর কান্না থামতে চায়না।বালিশ ভিজে যায়। বাবা যখন মারা যায় তখন সবাই ওর কান্না থামাতে চেষ্টা করেছিলো, কিš‘ এখন ওর কান্না থামাবে কে? কে ওকে সান্তনা দেবে। একি সহজে ভোলা যায়? দুই বছরের স্মৃতি কি এতো সহজে ভোলার?
তিথি একবার চিন্তা করলো ও আত্মহত্যা করবে। তাহলে এই নোংরা অসম্পুর্ন জীবন থেকে মুক্তি পাবে ও। আবার ভাবলো আগের জীবনে যদি ও সত্যিই পাপ করে থাকে আর এই জীবনে যদি প্রায়শ্চিত্তই ও করে থাকে তবে প্রায়শ্চিত্ত অসম্পুর্ন রেখে চলে গেলে তো পরের জীবনে আবারও একই প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। তারচেয়ে কষ্টটা ভোগ করেই যাক ও। কিš‘ ও কেন পারছেনা? কার কাছে ও বলবে এসব কথা? হঠাৎ বালিশ সরাতে গিয়ে গজুর গায়ে হাত লাগলো। পুতুলটা ওর বিছানার এক কোনে বসে ছিলো। ওর পরম বন্ধুর মতো। গজু ছাড়া ওর আর কোন খেলনা ছিলোনা কোনদিন। এই গজুকেই ও বন্ধু মনে করে এসেছে চিরদিন। রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে গজুকে জড়িয়ে ধরে মনের ভয়টাকে লুকোতে চাইতো। আজও গজুকে বুকে জড়িয়ে ধরে ও বলতে লাগলো,‘গজু কেমন আছিস তুই? আমার সব কথাতো তুই জানিস। এখন বল কি করবো আমি? আমিতো কিছুতেই নিজেকে ভোলাতে পারছিনা গজু।’
গজু আগের মতোই তার রাজপুত্তুরের মতো মুখটায় সুখের হাসি ফুটিয়ে রেখেছে। গায়ের পোশাকটা তার ময়লা হয়ে গেছে। তবে দীর্ঘ তেইশ বছরেও একটুও ম্লান হয়নি তার চোখের চাহনি। হঠাৎ ওর মনে হলো এই পুতুলটার ভেতরই তার বাবা আছেন। বাবা বসে বসে হাসছেন তার হাসি দেখে। ও সম্বোধন পাল্টে বললো,‘বাবা আমি ওকে ভালোবাসি। বিশ্বাস করো বাবা। আমি তোমাকে যতোটুকু ভালোবাসতাম, তোমার অবর্তমানে ওকে আমি ততোটাই ভালোবাসি। এই ভালোবাসায় কোন খাদ নেই বাবা। আমি আমার মন থেকেই ওকে ভালোবাসি। একেবারে মন থেকে। আমি ওর শরীরটাকে চাইনা বাবা। আমি ওর হৃদয়টাকে চাই। আমি ওর হৃদয়টাকে চাই। আমি ওর হৃদয়টাকে চাই। আমি ওর হৃদয়টাকে চাই। আমাকে ওর হৃদয়টা এনে দাও বাবা, আমাকে ওর হৃদয়টা এনে দাও...।
আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো তিথি। চোখের লোনা জলে ফুলতোলা চাদরটার জায়গায় জায়গায় ছোপ পড়লো। চোখ মুছে ঘড়ির দিকে তাকালো ও। ঘড়িতে দুপুর বারোটা বেজে গেছে। আজ সার্জিলের বিয়ে। ওরা এতো তাড়াতাড়ি করছে যেন সার্জিলকে বিয়ে দিতে পারলেই তিথির মতো অপয়া একটা মেয়ের হাত থেকে মুক্তি পাবে। মাথা নিচু করে বাথরুমে ঢুকলো তিথি। ভালো করে গোসল করলো। আজ ও সুন্দর করে সাজবে। এমনিতে ও বেশ সুন্দর। তারপর সাজলে ওকে নিশ্চয় আরো সুন্দর লাগবে। নিজেকে কি ওর বউ বউ লাগবেনা একটু? দেখা যাকনা কি হয়। যদি মনের স্বাদটা কিছুটা মেটে। যদি কষ্টের বেগ কিছুটা কমে এতে!
গোসল সেরে বেরুতে বেরুতেই আধ ঘন্টা। সার্জিলদের বাড়ি থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যা”েছ। বিয়ে বাড়িতে যা হয়। তবে একটু ভিন্ন ধরনের। মনে হ”েছ যেন সবাই একসাথে চিৎকার করছে। কেউ কেউ কি আবার আর্তনাদ করছে? তাই তো মনে হ”েছ। তিথি তাড়াতাড়ি বের হয়ে এলো বাথরুম থেকে। সাধারনত গোসল করতে ওর এত সময় লাগেনা। আজ একটু ভিন্ন মানসিকতা কাজ করায় ওর গোসল সারতে দেরী হয়েছে। বারান্দায় চলে এলো ও। এই বারান্দা থেকেই সার্জিলের সাথে ইশারায় কথা বলতো তিথি। এখান থেকে পরিস্কার দেখা যায় বাড়ির ভেতরটা। তিথি দেখলো আতঙ্কিত লোকজন বাড়ির এদিক ওদিক দৌড়া”েছ আর খুন খুন করে চিৎকার করছে। ওদের বাড়ির বারান্দার কাছে লোকজন ভিড় করছে। একজন বারান্দা থেকেই চিৎকার করে রাস্তার একজনকে উদ্দেশ্য করে বললো,‘সার্জিলকে খুন করা হয়েছে। কে যেন ওকে বীভৎস্যভাবে খুন করেছে। ও মাই গড! জাস্ট ছিঁড়ে ফেলেছে ওকে। পুলিশ পুলিশ!
তিথি যেন জমে গেল। আতংক ওকে পুরোপুরি গ্রাস করে নিলো। কষ্ট আর আতংক একসাথে এলে যে অদ্ভুত অনুভুতি সৃষ্টি হয় তা বর্ননাতীত। তারপরও সারাজীবন কষ্ট পেয়ে আসা তিথি নিজেকে সামলে নিলো। তাড়াতাড়ি হেঁটে বেডরুমে ঢুকে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো ও। সারা শরীর আবারও অসাড় হয়ে এলো। বিস্মিত হতভম্ব দৃষ্টিতে নিজের বিছানার দিকে তাকিয়ে রইলো তিথি। ওর বিছানার চাদরের মাঝখানটা রক্তে মাখামাখি। মনে হ”েছ যেন চাদরে কেউ টমেটোর সস লেপে দিয়েছে। লাল সস। তার ঠিক মাঝখানটাতে একটা টেনিস বলের মতো পড়ে আছে একদলা মাংসের টুকরো। টুকরোটা তখনও একটু একটু নড়ছে। ওটা একটা মানুষের হৃৎপৃন্ড। সার্জিলের হৃৎপৃন্ড। আর রক্তে মাখামাখি জায়গাটা থেকে একটু দুরে বালিসের গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে গজু। আগের মতোই তবে পুতুলের হাতটাতে রক্ত লেগে আছে।
হায়রে বোকা গজু, তিথির কথাটার সঠিক অর্থ ও বুঝতে পারেনি। তিথি বলেছে সার্জিলের হৃদয়টা চাই। পরম বন্ধুর মতো তাই সে করে বসেছে। এনে দিয়েছে সার্জিলের হৃদপৃন্ডটা।
গজুর চেহারাটা কি সুখী সুখী দেখা”েছ। জীবনে পরম বন্ধুর মতো একটা কাজ করে দিয়েছে মমতাময়ী বন্ধুর জন্য। তাইতো এতো সুখ পুতুলটার মনে।
0 comments:
Post a Comment