দিগন্তের একজন
যে বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম সে বছর অনেক গরম পড়েছিলো। প্রচন্ড গরমে ক্লাস করতেও ইচ্ছে করতোনা। আমাদের বাড়িতে সার্বক্ষনিক এসি চলে কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে এসির কথা তো ভাবাই যায়না। স্বাভাবিকভাবে দুপুরের দিকে গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে যখন ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে আসতাম টিএসসির বিশাল বিশাল গাছগুলোর নিচে দাঁড়িয়ে একটু শীতল হবার চেষ্টা করতাম সবাই মিলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী ডিপার্টমেন্টের দিকে সবারই একটু বেশী নজর থাকে। সেই কারনেই আমাদের ব্যাচে প্রচুর ছাত্রছাত্রী এবারও ভর্তি হলো। এমন অবস্থা যে বেঞ্চে বসার জায়গাও নেই। ক্লাসে সবাই আন্তরিক। ছেলে মেয়ে কোন ভেদাভেদ নেই। ফার্স্ট ইয়ারে যা ক্লাস হয় তার চেয়ে বন্ধুত্ব হয় বেশী।
সবার সাথে পরিচয় করতে করতেই দিন যায়। তিন মাস যেতে না যেতে সবার সাথে এমন বন্ধুত্ব হয়ে যায় যে মনে হয় এরা আমার কতো দিনেরই না চেনা। আমি যে একটা মেয়ে এটা আমার প্রায়ই মনে থাকেনা। কেবল আয়নায় দাঁড়ানোর পরই এটা মনে আসে আমার। আমার মা প্রায়ই হাসতে হাসতে বলেন, আমার মেয়েটা এতো সুন্দরী যে ওর জন্য পাত্র দেখাও লাগবেনা। আমার মেয়ের জন্য একটা রাজপুত্র জোগাড় হয়ে যাবে। আমি হেসে বলতাম, কিযে বলোনা মা, এখনই এসব কথা ভাবো তুমি!
যে বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম সে বছর অনেক গরম পড়েছিলো। প্রচন্ড গরমে ক্লাস করতেও ইচ্ছে করতোনা। আমাদের বাড়িতে সার্বক্ষনিক এসি চলে কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে এসির কথা তো ভাবাই যায়না। স্বাভাবিকভাবে দুপুরের দিকে গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে যখন ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে আসতাম টিএসসির বিশাল বিশাল গাছগুলোর নিচে দাঁড়িয়ে একটু শীতল হবার চেষ্টা করতাম সবাই মিলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী ডিপার্টমেন্টের দিকে সবারই একটু বেশী নজর থাকে। সেই কারনেই আমাদের ব্যাচে প্রচুর ছাত্রছাত্রী এবারও ভর্তি হলো। এমন অবস্থা যে বেঞ্চে বসার জায়গাও নেই। ক্লাসে সবাই আন্তরিক। ছেলে মেয়ে কোন ভেদাভেদ নেই। ফার্স্ট ইয়ারে যা ক্লাস হয় তার চেয়ে বন্ধুত্ব হয় বেশী।
সবার সাথে পরিচয় করতে করতেই দিন যায়। তিন মাস যেতে না যেতে সবার সাথে এমন বন্ধুত্ব হয়ে যায় যে মনে হয় এরা আমার কতো দিনেরই না চেনা। আমি যে একটা মেয়ে এটা আমার প্রায়ই মনে থাকেনা। কেবল আয়নায় দাঁড়ানোর পরই এটা মনে আসে আমার। আমার মা প্রায়ই হাসতে হাসতে বলেন, আমার মেয়েটা এতো সুন্দরী যে ওর জন্য পাত্র দেখাও লাগবেনা। আমার মেয়ের জন্য একটা রাজপুত্র জোগাড় হয়ে যাবে। আমি হেসে বলতাম, কিযে বলোনা মা, এখনই এসব কথা ভাবো তুমি!
মায়ের কথাই ঠিক। ক্লাসে গেলেই দেখতাম সবাই কেমন যেন আমার জন্য উদগ্রীব। আমি একদিন না গেলেই যেন সবার মাঝে কেমন এক বিষন্নতা কাজ করে। ছেলে কিবা মেয়ে সবারই কেন্দ্রবিন্দু আমি। হয়তঃ ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী বলেই সবাই আমার সঙ্গ পেতে চাইতো। আমরা ক্লাসে অনেক আনন্দ করতাম। ফার্স্ট ইয়ারে তেমন ক্লাস হয়না। সেই বছরটা পুরোপুরি কাটে টিএসসিতে কিংবা ক্লাসের টানা করিডোরে। কেউ একদিন সবাইকে আইসক্রিম খাওয়ায় তো আরেকজন সবাইকে চা খাওয়ায়। যখন ক্লাস থাকেনা, কেউ একজন কোত্থেকে একটা গিটার বের করে গান শুরু করে দেয়। আর সবাই তার তালে দুম দুম করে বেঞ্চে বাড়ি মেরে ড্রামের তাল দেয়।
এভাবেই দিন যেতে থাকে। সবাই বেশ উচ্ছল, কেবল একজন ছাড়া। ছেলেটা তেমন নয়, কেমন রোগা, মাথায় উস্কোখুস্কো চুল দেখলে মনে হয় যেন কোন কালে তেল পড়েনি সেখানে। ফর্সা চেহারা কিন্তু কোন সৌন্দর্য নেই। চোখের কোলে কালি, তবে সেটা দেখা যায়না তার ভারি প্লাস্টিক ফ্রেমের চশমার কারনে। প্রতিদিন একই জামাকাপড় পরে আসে। এসে চুপচাপ পেছনের বেঞ্চে বসে থাকে। কখনও কারো সাথে কথা বলেনা। নত দৃষ্টি থাকে বইয়ের পাতায় নিবদ্ধ। প্রতিদিন একই বেঞ্চের একই জায়গায় বসে সে। আমরা যখন আনন্দ করি, গান গাই, সবাই মিলে খেতে যাই সে ক্লাসের পেছনের বেঞ্চেই বসে থাকে চুপচাপ। ক্লাস শেষে চুপিচুপিই কোথায় চলে যায়। প্রথম দিকে আমরা ভাবতাম ছেলেটা বোধহয় লাজুক বা একটু আনস্মার্ট। কিন্তু দিনের পর দিন তার সহজ হতে না পারা দেখে একসময় আমরা তার ব্যপারে রসিক হয়ে উঠলাম। তাকে নিয়ে আমরা গান বানাতাম। তাকে বলতাম ‘মিঃ পচা কুমড়ো।’ সে সবই বুঝতো কিন্তু কোন জবাব দিতোনা। মাঝে মাঝে খুব রাগ হতো তার এই নীরব চাউনি আর চুপচাপ একা বসে থাক দেখে। এমন একটা ভাব যেন পৃথিবীতেই সে নেই। চার পাঁচজন মিলে পরিকল্পনা করে তার বসার সিটটায় গাম লাগিয়ে রাখি। গামে তার প্যান্ট ভিজে যায়। তাই নিয়ে সে চুপচাপ বসে থাকে। আরেকদিন পেছন থেকে আমি তার সাদা শার্টে কালো কালি লাগিয়ে দেই। সে বুঝতে পারলেও কিছু বলেনা।
দিন যায় আর তাকে নিয়ে আমাদের কৌতুহলে ঘাটতি পড়ে। একই বিষয় নিয়ে তরুন সমাজ দীর্ঘদিন মাতামাতি করতে পছন্দ করেনা। আরেকটা নতুন বিষয় সামনে আসে, আর আমরা তাকে ভুলে যাই সম্পুর্নভাবে। কিন্তু সে একই রকম থাকে। মাঝে মাঝে শার্ট প্যান্ট চেঞ্জ করে তবে খুব কমই। একদিন জানলাম হলে থাকে সে। কে যেন তথ্যটা দিলো ভুলে গেছি। বললো ছেলেটা নাকি বেশ গরীব ঘরের ছেলে। এই কথাটা জানতে পারার পর আমরা পুরোপুরি তার সাথে দুষ্টুমি করা থামিয়ে দিলাম। সবাইকে নিষেধ করে দিলাম যেন তাকে নিয়ে কেউ ফাজলামী না করে। থাক সে তার মতো। আমাদের তো আর কোন সমস্যা হচ্ছেনা সে কথা না বলতে চাইলে। সবাই আমার কথা মেনে নিলো। একদিন সেলিম নামে আমাদের ক্লাসের একজন তার সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য আমাদের দিলো যা শুনে আমার ভিত্তি নড়ে উঠলো পুরোপুরি। সেলিম বললো, ছেলেটার নাম হাসান, পুরো নাম জাহিদ হাসান। খুবই গরীব ঘরের ছেলে সে। ঢাকার ছেলে হলে কি হবে এক টুকরো জমি ছাড়া তার আর কিছুই নেই। ছোট বেলায় মা বাবা মারা যাওয়াতে সে বড়ো হয়েছে খালা খালুর কাছে। খালা খালুর তেমন টাকা পয়সা ছিলোনা। ফলে তাকে কখনও ফল বিক্রি করে, কখনও বাদাম বিক্রি করে পড়াশোনা চালাতে হয়েছে। এমন দিন গেছে সে ভাত খেতে পারেনি। দু’মুঠো মুড়ি খেয়ে পরীক্ষা দিতে গেছে। এভাবেই সে খুব ভালো রেজাল্ট নিয়ে ভর্তি হয়েছে কলেজে। তারপর একইভাবে বিভিন্ন কাজ করে, মুটে খেটে যা পেয়েছে তাই দিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে গেছে। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করেছে। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। এই চান্স পাওয়াটাও তার ভাগ্যের জোরে। যে হলে সে থাকে সেখানে সেলিমের এক বন্ধুও থাকে। সে বললো মাঝে মাঝে তার বাথরুমে কিছু চিড়া খুঁজে পেয়েছে তারা। অনেক চাপাচাপি করেও কোন লাভ হয়নি। হাসান কোন তথ্য দেয়নি। কিন্তু খুব শীঘ্রি তারা হাতে নাতে হাসানকে ধরে ফেলে। দেখে হাসান বাথরুমের ভেতর ঢুকে ভেজানো চিড়া লবন মাখিয়ে খাচ্ছে। পরে অনেক চাপ দেবার পর জানায় যে হাসান অনেক কষ্টে পড়াশোনা করছে। তার খাবার টাকাও নেই। তাই পড়াশোনা চালাবার জন্য সে কমদামে চিড়া নিয়ে ভিজিয়ে রাখে তারপর কেউ যাতে না দেখতে পায় সেই জন্য বাথরুমে ঢুকে খেয়ে নেয়।
এসব জানার পর হাসানের প্রতি আমার এক ধরনের সমবেদনা গড়ে উঠলো। সবাইকে বলে দিলাম যেন ওর সাথে কোন রকম ফাজলামী না করে বা পচা কুমড়ো না বলে। আমার এসব কথা শুনে সবাই বেশ অবাক হলো, কিন্তু কাউকে বললাম না যে ওর ব্যপারে অনেক কথা শুনেছি আমি বা বললামও না যে কি শুনেছি। আমার কথায় সবাই ওর সাথে দুষ্টুমি করা ছেড়ে দিলো একেবারে। ওকে দেখলেই আমার ভেতর কেমন একটা কষ্ট গড়ে উঠতে লাগলো। একটা অজানা কষ্ট। একটা অজানা সমবেদনা। এমন অনুভুতির সাথে আমি একেবারে পরিচিত নই। আমার ইচ্ছে হতো ওর সাথে কথা বলতে। মাঝে মাঝে কোন কারন ছাড়াই ওকে নাম ধরে ডাকতাম, ওর দিকে তাকিয়ে হাসতাম। হাসান কোন জবাব দিতোনা, ওর লাজুক চোখ একবার তুলে দেখে নিতো কেবল আমাকে। মাঝে মাঝে পাশে গিয়ে বসতাম হাসানের। কোন কথা জিজ্ঞেস করলে কেবল মাথা নেড়ে জবাব দিতো সে। বড়ো কোন প্রশ্ন করলে চুপ করে থাকতো।
ক্লাসের সবাই বেশ অবাক আমার ব্যবহারে। রূপা তো সবার সামনে না থাকতে পেরে বলেই বসলো,‘কিরে তুই প্রেমে পড়েছিস নাকি? তাও আবার পচা কুমড়োর? বিউটি এ্যান্ড দ্যা বিস্ট?’
‘দেখ রূপা,’ আমি বললাম,‘এই ব্যপারটা নিয়ে আমাকে একদম ঘাঁটাবিনা। আর এই ব্যপারটা নিয়ে কথা হোক তা আমি একদম চাইনা।’
সবাই চুপ। ক্লাসের সব ছেলেরাই আমার ব্যপারে বেশ কৌতুহলী ছিলো প্রথম থেকে। আমাকে তাদের ছোট ছোট গ্রুপে পাবার জন্য রীতিমতো ভোট হয়ে যেতো। কেউ কেউ আগ্রহী হয়ে অনেক রকম চিঠিও পাঠিয়েছে আমাকে। আমি হেসে উড়িয়ে দিয়েছি। মনের দিক থেকে সাড়াও পাইনি কোন। কিন্তু এ কেমন অনুভুতি আমি বুঝতে পারিনা। আমি যেন অনেকটা নির্লজ্জ হয়ে উঠেছি হাসানের ব্যপারে। ইদানিং ক্লাসে এসেই ওকে খুঁজি। ওর পাশের সিটে বসি। একদিন কমন রুমে আমি, রূপা, তানিয়া আর নিতু বসে আড্ডা দিচ্ছি হঠাৎ দেখি হাসান উদগ্রিব হয়ে আমাদের দিকে আসছে। ও কি যেন বলার চেষ্টা করছে। কাছে এসে যখন কথা বলতে চাইলো দেখলাম ও একেবারে বোবা। ফার্স্ট ইয়ার ফাইনালের রেজাল্ট কার্ডটা ও ধরে আছে। হাসান কথা বলতে পারেনা এই প্রথম জানতে পারলাম। দেখলাম পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশী নম্বর ওই পেয়েছে। আমার এতো আনন্দ লাগলো যে আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম। ও তাড়াতাড়ি নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। আমার ডান হাতটা টেনে নিলো নিজের হাতে তারপর পকেট থেকে কলম বের করে আমার হাতের তালুতে লিখলোঃ তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও। তারপর দ্রুত পায়ে চলে গেল করিডোরে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর গমন পথের দিকে। সবাই ঝুঁকে এলো আমার হাতের তালুতে কি লিখেছে হাসান দেখার জন্য। রূপা বললো, ‘নিশ্চয়ই লিখেছে আই লাভ ইউ!’ আমি কোন জবাব দিলামনা। কাউকে দেখালামওনা যে কি লিখেছে হাসান।
প্রতিদিন সকাল ন’টায় বাড়ি থেকে রওয়ানা হই আমি নিজেদের প্রাইভেট কারে করে। আজ আড়াইটা বেজে যাচ্ছে ড্রাইভার আসছেনা দেখে আমি বেশ রেগে উঠলাম। বাবা ব্যবসায়ীক কাজে বিদেশে থাকায় বাড়িতে কেবল মাই থাকে। কাজের বুয়া আছে আর একটা মেয়ে সব কাজ করে। ড্রাইভারকে ফোন দিলাম আমি। প্রথম রিঙে সে ধরলোনা। দ্বিতীয়বার রিং হতেই সে হৈহৈ করে উঠলো,‘আপা আম্মা তো হাসপাতালে। স্কয়ারে ভর্তি করসি। হঠাৎ স্ট্রোক করসে। আপনার নাম্বার তো সেভ করা নাই তাই আপনেরে ফোন দিবার পারিনাই....।’
এরপরের দৃশ্য বেশ সুখকর নয়। আমি যখন ট্যাক্সি নিয়ে স্কয়ারে পৌছুলাম তখন সব শেষ। আমার মা ইহলোক ত্যাগ করে চলে গেছেন পরলোকে। বড় আপা বললেন তিনি মাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আমাকে ফোন দিতে পারেনি। বড় ভাইকে খবর দেয়া হয়েছে। তিনি মাত্র সিঙ্গাপুর থেকে ফিরেছেন। ছোটভাইটা গুলশানে একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। এরা কেউই আমাকে ফোন করে জানায়নি দুঃসংবাদটা। জানিয়েছে হাসান। কথা হচ্ছে সে জানলো কিভাবে যে মায়ের হার্ট এ্যাটাক হয়েছে?
যাক যা হবার তাই হলো। মায়ের সাথে তো দেখা হলোনা আমার। হয়তঃ হাসানের কথা মতো যদি আরেকটু আগে বাড়ি চলে যেতে পারতাম তাহলে হয়তঃ মা বেঁচে যেতে পারতো। অনেক দিন ভার্সিটিতে যাওয়া হলোনা। অনেকে এলো আমাকে দেখতে। সান্তনা দিতে। সেলিমও এলো। ও কিভাবে যেন জেনে ফেলেছে হাসানের বিশেষ কিছু কথা। আমাকে আড়ালে ডেকে বললো, তোমার মায়ের ব্যপারে নাকি ও ভবিষ্যতবানী করেছিলো? আমি বললাম, ‘না তা বলেনি। তবে আমাকে বাড়ি যেতে বলেছিলো।’
সেলিম মাথা দোলালো,‘এটা হাসানের একটা ভয়ংকর দিক। ওকে অনেকে নাকি খুব ভয় পায়। ও নাকি মানুষের ভবিষ্যত দেখতে পায়। যার সম্পর্কে বলে সব ঠিক বলে। ছোটবেলা থেকে বোবা হওয়ার কারনেই কারো সম্পর্কে কিছু বলতে চাইলে সে লিখে জানায়। এটা নাকি ওর কানে কানে কেউ বলে যায়। আজ পর্যন্ত হাসানের কোন ভবিষ্যতবানী ভুল হয়নি।’
দশদিন পর আজ আবার ভার্সিটিতে গেলাম। যে চলে যাবার সে তো চলেই গেছে। আমার ভার্সিটিতে না যাওয়ার কি আছে? আমার মন পড়ে আছে ভার্সিটিতে। হাসানের কাছে। আমি বুঝতে পারছি আমি একটা বড়ো ভুল করে ফেলেছি। হাসানকে আমার মনে স্থান দিয়ে ফেলেছি। বুঝতে পারছিনা কি করা উচিৎ এখন আমার। তবে এটা বুঝতে পারছি যে নড়াচড়া করি আর নাই করি ক্রমাগত চোরাবালিতে তলিয়েই যাবো। তলিয়ে যাওয়াই আমার নিয়তি। ভার্সিটিতে গিয়ে খারাপ সংবাদটা শুনলাম। হাসান নাকি গত দশদিনে একবারও ভার্সিটিতে আসেনি। শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। ভেবেছিলাম ওর সাথে দেখা হলে মন কিছুটা হলেও ভালো হয়ে যাবে। এখন মন আরও খারাপ হয়ে গেল। সিদ্ধান্ত নিলাম ওর হলে যাবার। ক্লাস শেষ হওয়া মাত্র রওয়ানা দিলাম ওর হলের দিকে। হলে গিয়ে শুনলাম হাসান নাকি ওর সব মালপত্র নিয়ে চলে গেছে বাড়িতে। মালপত্র বলতে একটা ভাঙ্গা সুটকেস আর একটা বালিশ আর মশারি। খলিল নামে তার রুমমেট জানালো মিরা নামে এক মেয়ের জন্য একটা এনভেলাপ মোড়া চিঠি রেখে গেছে হাসান। আমি খলিলকে জানালাম যে আমিই মিরা। খলিল আমাকে চিঠিটা দিলো। আমি তৎক্ষনাত চিঠিটা খুললাম না। বাড়িতে ফিরে নাস্তা সেরে, ছাদে গেলাম। তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা। আকাশের নীলের সাথে তখনও লুকোচুরি খেলছে সাদা মেঘ। তাতে সোনালী আভা ছড়িয়েছে পলাতক সুর্য্যটা। চিলেকোঠার আড়ালে একটা মোড়া নিয়ে বসে হাসানের চিঠিটা খুললাম। ওর হাতের লেখা যে এতো সুন্দর মনে হয় প্রত্যেকটা অক্ষর টাইপ করা। হাসান লিখেছেঃ
‘প্রিয় মিরা,
আমি জানি তুমি এই চিঠিটার জন্যই আসবে আমার হলে তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কাউকে না জানালেও আমি তোমাকে আমার সব ঘটনা জানাবো। জানো মিরা আমি জন্মগ্রহন করেছিলাম একটু অদ্ভুতভাবে। জন্মের পরপর বাবা মা দু’জনই মারা গেল। তিন বছর বয়সে কি বুঝবো আমি? ছোটবেলা থেকে তো আমি কথাই বলতে পারিনা। একটা বোবা ছেলে কিভাবে এই নিষ্ঠুর সমাজে বেঁচে থাকবে সেটা জানতে পারলাম পাঁচ বছর বয়সে। যখন থেকে আমি পৃথিবীর সব ঘটনাই বুঝতে শিখেছি। কিভাবে কাজ করলে টাকা পাওয়া যায়। এই টাকার জন্য কতো কষ্টকর কাজই না করেছি আমি। জানতাম টাকা না থাকলে আমি পড়াশোনা করতে পারবোনা। আর পড়াশোনা না করতে পারলে আমি বড়ো হতে পারবোনা। তাই কখনও বাদাম বিক্রি করেছি আবার কখনও বাজারে শাকশব্জি নিয়ে বসেছি। এভাবেই পড়াশোনা চালিয়ে গেছি। একটা গোপন কথা তোমাকে বলি। আমি মানুষের ভাগ্য পড়তে পারি। তুমি তো নিশ্চয় বিশ্বাস করো ¯্রষ্ঠা একজন আছেন এবং তিনি কোটি কোটি বছর আগে থেকেই প্রতিটা মানুষের ভাগ্য আলাদা আলাদাভাবে লিখে রেখেছেন। আমি মানুষের চোখের দিকে তাকালে তার সেই দুর্বোধ্য ভাগ্য রেখা আমার চোখে ধরা পড়ে যেত। ভবিষ্যত পড়তে পারার ক্ষমতা আমি শিখেছি সেই বয়স থেকেই। আরেকটা ক্ষমতা আমার মধ্যে আছে যা হলো আমি মানুষের মন নিয়ন্ত্রন করতে পারি। এটা খুব খারাপ একটা কাজ। আমি ইচ্ছে করলেই আমার ইচ্ছেকে যে কারোর ইচ্ছেতে পরিনত করতে পারতাম। এখনও পারি। ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তির সময়ও এটা আমি প্রয়োগ করেছিলাম। তাই রুলিং অফিসারের ভেতর আমার ইচ্ছেটাকে ঢুকিয়ে দিয়ে সবার মন জয় করে নিয়েছিলাম। তা নাহলে আমার মতো একটা বোবা ছেলে কি এতো সহজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে? আমি জানতাম রাসপুটিনের মতো ভয়ংকর ক্ষমতা আছে আমার মধ্যে। কিন্তু রাসপুটিন সেটা প্রয়োগ করতো আর আমি প্রয়োগ করাটাকে পাপের কাজ মনে করতাম। কিন্তু তোমাকে দেখার পর আমার খুব ভালো লেগে গেল। তুমি কি জানো যে একটা মানুষ যতো বিশ্রীই হোক তার চেহারা সেও স্বপ্ন দেখে একটা রাজকন্যার মতো মেয়েকে কাছে পাবার। আমি জানতাম আমি একটা রাস্তার কুকুরের মতো যার কোন যোগ্যতাই নেই। তোমার সৌন্দর্য্যরে কাছে তোমার অর্থের কাছে আমি কিছুইনা। তারপরও তোমার জন্য আমার মনটা ব্যাকুল হয়ে থাকতো। ক্লাসে তুমিই আমার সাথে সবচেয়ে খারাপ আচরন করতে। সিন্ধান্ত নিলাম তোমার মনকে নিয়ন্ত্রন করার। জানি খুবই খারাপ পাপ এটা তারপরও করতে শুরু করলাম কারন তোমাকে যে আমি মন থেকে ভালোবেসে ফেলেছি! আমি কি করবো বলো? তুমি ধীরে ধীরে আমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়লে। এটা কিন্তু এই নয় যে তুমি আমাকে দেখে ভালোবেসেছো বা আমার প্রতি মোহগ্রস্থ হয়ে পড়েছো। এটা এই জন্যই যে আমি তোমার মনটাকে নিয়ন্ত্রন করেছি। তুমি আমার পাশে বসতে চাইতে আমার সাথে কথা বলতে চাইতে, আসলে এসব ছিল আমার ভাবনা, আমার ইচ্ছে। আমি কেবল এসব ভাবনা তোমার ভিতর প্রথিত করেছিলাম। জানতাম এসব কখনও বাস্ততে পরিনত হবেনা। আমি যখনই এসব বন্ধ করবো তুমিও ভুলে যাবে আমাকে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম এসব বন্ধ করার। কিন্তু আমি কিভাবে বাঁচবো? জীবনেও কোন মেয়েকে আমি ভালোবাসিনি। কারোর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়িনি এতোটা। যে ছেলে জীবনে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করে সে কিভাবে ভালোবাসার স্বপ্ন দেখবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকলে যতো বার তোমাকে দেখবো ততোবারই আমার মন ভেঙে যাবে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম পড়াশোনা ছেড়ে দেয়ার। তাছাড়া পড়াশোনা করতে গেলে আয় উপার্জন করা যায়না। যে সময়টা ক্লাসে থাকি সেই সময়টা কোন বাজারে শাক শব্জি নিয়ে বসলে কিছু আয় করতে পারবো। আর কতো পারা যায় দুপুরবেলা না খেয়ে থাকতে, কতো রাত পারা যায় শুরু শুকনো চিড়া খেয়ে থাকতে? তাই সিদ্ধান্ত নিলাম সব ছেড়ে দেবো। আমি দুরে সরে গেলেই তুমিও আমাকে ভুলে যাবে। আমি ইচ্ছে করলে তোমার মন নিয়ন্ত্রন করতে পারতাম। তোমাকে কাছে টেনে আনতে পারতাম। তোমাকে বিয়ে করতে পারতাম। কিন্তু একদিন তুমি বুঝতে পারতে তুমি বিরাট একটা ভুল করেছো। আমার মতো অসহায় পিতা মাতাহীন সহায় সম্বলহীন বোবাছেলেকে বিয়ে করা মানে নিজের পায়ে কুড়োল মারা। তাই এখানেই ইতি টানলাম সব কিছুর। যদি পারো আমাকে ক্ষমা করো। কারন সামনে এলে আমি তোমাকে খুলে বোঝাতে পারতামনা সবকিছু, কারন মুখের ভাষা আমার নেই। তাই লিখেই বোঝালাম। ভালো করে পড়ালেখা করো। আর একটা কথা গোপনে বলে রাখি। তোমার বাবা একটা পাত্র দেখেছেন গুলশানে। তাকে দেখে তোমার পছন্দ হবে। খুবই সুন্দর দেখতে। বাবার একমাত্র ছেলে। পারিবারিক ব্যবসা আছে। আগামী দশ বছর পরে তোমাদের একটা পুত্র সন্তান হবে। আমি তোমার ভাগ্য পড়ে নিয়েছি আগেই। তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার এটাও একটা কারন। বিধাতার লেখা ভাগ্যের ওপর আমি বাগড়া দিতে চাইনা। আমি দোয়া করি তুমি সুখী হও।
ইতি
জাহিদ হাসান
আকাশের দিকে তাকালাম আমি। মনে হলো সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছে। আমি একটা ঘোরের ভেতর আছি। মনে মনে বললাম আমি তোমাকে ভালোবাসি হাসান। মন থেকে ভালোবাসি। এটা কোন জাদুর কারনে কোন শক্তির কারনে নয়। এটা একজোড়া মানব মানবীর মনে আদিমতম সিন্ধান্ত। হয়তঃ তুমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছো। কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবেসে যাবো। চিরকাল।
( তুহিন রহমানের কপিরাইটকৃত ছোটগল্প।)
0 comments:
Post a Comment